রাজনৈতিক দলের খবরদারীতে বিলুপ্ত সামাজিক দল
ভয়ঙ্কর এক জনপদ শৈলকুপা;গ্রামে গ্রামে খুন-যখম, লুটপাট-চাঁদাবাজি, বাড়ি-ঘর ভাংচুর
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা, এক অশান্তির জনপদ। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটপাট ও খুনের ঘটনায় মামলা-মোকদ্দমায় মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। অনেক বছর আগ থেকেই শৈলকুপা একটি অশান্তির এলাকা বলে প্রশাসনের কাছে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু শিক্ষাদীক্ষায় সমৃদ্ধ। সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আছেন এ উপজেলার।
গড়াই ও কুমার নদীর তীরের এ জনপদে বর্তমানে লোকসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। প্রবীণরা বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে এ এলাকার মানুষ সহিংস প্রকৃতির। প্রতিটি গ্রামে সামাজিক দল রয়েছে। প্রতি দলের একজন মাতুব্বর আছে। সামাজিক আধিপত্য, জমিজমাসহ নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। যার লাঠির জোর বেশি সে মাতুব্বরের ক্ষমতা বেশি, এমন ধারণা মানুষের মধ্যে। সারা বছর ধরে চলে তাদের মধ্যে ভিলেজ পলিটিক্সের কুটচাল। এক দল আরেক দলকে ঘায়েল করায় ব্যস্ত থাকে।
বর্তমানে গ্রামের সামাজিক দলগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। মূলত রাজনৈতিক দলগুলির আধিপত্য বিস্তার হয়েছে গ্রামাঞ্চলের সামাজিক দলগুলিতেও। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ করে তুলেছে রাজনৈতিক নেতারা যে, তাদের চাপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সামাজিক দল। এখন কারো ছেলে-মেয়ের বিয়ে, খানা-অনুষ্ঠানাদি, মুসলমানী, জন্মদিন এমনকি মরা বাড়ির চল্লিশাতেও দাওয়াত দিতে হয় রাজনৈতিক নেতাদের। নইলে সেই পরিবার কে একঘরে করে রাখা হয়।
গ্রামে এক মাতুব্বরের দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হলে, তার প্রতিপক্ষ দল বিএনপির সঙ্গে যুক্ত । তবে এখন বিএনপির প্রতাপ নেই, দাপটও নেই । তাই সব মাতুব্বররা হয় প্রত্যক্ষ নয় পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে। আর আওয়ামী লীগে রয়েছে গ্রুপিং। ফলে মাতুব্বররাও গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েছে। এই ফাঁকে ভিলেজ পলিটিক্সে পটু কিছু মাতুব্বর ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বন্দ্ব, সংঘাত আর সহিংসতা কে উষ্কে দিয়ে আগুনে ঘি ঢালা অবস্থা করছে এবং ব্যাক্তি স্বার্থ উদ্ধার করে নিজের পরিবার, গোষ্ঠী কে লাভবান করছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এলে তারা নিজ দলের লোককে চেয়ারম্যান মেম্বর করতে মাঠে নামে। তাদের মধ্যে শত্রুতা আরো বাড়ে। ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে কাইজা দাঙ্গায় লিপ্ত হয়। জড়িয়ে পড়ছে সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষও।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি হানাহানি ঘটছে সারুটিয়া ইউনিয়নে। খুনের জনপদ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এখানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে-পরে দুই পক্ষে সাত জন খুন হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে খুনগুলি ঘটেছে। আর এসব মামলায় আসামি হয়েছে ৫০০-৬০০ মানুষ। ঘটনার পর লোকজন গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে যায়। পুরো জনপদ যেন শ্বশান। আসামিদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে-হচ্ছে। এমনকি নারী নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। সেই সঙ্গে চলে চাঁদাবাজি, গরু-ছাগল লুট এমন কি কবুতর, হাঁস-মুরগি কিচ্ছু রাখা হয়নি সারুটিয়া জুড়ে।
উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নেও বর্তমান চেয়ারম্যান ও সাবেক চেয়ারম্যানের মধ্যে সাপে নেউলে সংঘর্ষ। বড়বাড়ি বগুড়া ও বারইহুদা গ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই দলের সংঘর্ষ হয়েছে। সম্প্রতি তিনটি সংঘর্ষে অন্তত ৫০-৬০ জন আহত হয়েছে। আর ভাঙচুর লুটপাট হয়েছে প্রায় ৪০টি বাড়ি। ৫ জানুয়ারি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের পর ৮ জানুয়ারি খুন হয় এক যুবক।
১২ নম্বর নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নেও বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে চলছে চরম শত্রুতা। প্রতিটা গ্রামে মাতুব্বররা দুই শিবিরে বিভক্ত। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে শেখরা গ্রামে। দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন আহত হয়। বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট হয় ৪০টি।
শৈলকুপা পৌর এলাকায়ও দুই দলের মধ্যে তীব্র শত্রুতা চলছে। এর জেরে সংঘর্ষ ভাঙচুর হয়েছে। এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটেছে। অন্যান্য ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে মাতুব্বরদের রেষারেষিতে অশান্তিতে আছে।
সামাজিক দলগুলিতে রাজনৈতিক দল ভিড় করায় সহিংসতা কোন অবস্থাতেই কমানো যাচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন সহ পুলিশ কে তারা ক্ষমতার জোরে ব্যবহার করছে । অপরাধি সহ সন্দেহভাজ কাউকে আটক করলে নেতাদের তাৎক্ষনিক সুপারিশ আসতে থাকে।
থানা পুলিশ জানায়, উপজেলার প্রায় বাড়িতে ঢাল, সরকি, রামদা, তলোয়ার, লাঠিসোঁটা মজুত থাকে। কাইজা লাগলে এসব দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
গ্রামাঞ্চলে অনেক নিরীহ মানুষ আছে, তারা শান্তিপ্রিয়। কিন্তু কোনো না কোনো মাতুব্বরের দলে যোগ না দিয়ে বসবাস করতে পারে না। মনোহরপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুদিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তাদের গ্রামেও দুটি দল আছে। নিরপেক্ষ থাকা যায় না। কোনো দলে না গেলে মাঠের ফসল নষ্ট করা হয়। নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। সারুটিয়ার ব্রহ্মপুর গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তাদের গ্রামে দুটি সামাজিক দল আছে। এক দল চেয়ারম্যান মামুনের সমর্থক, অন্য দল টিপুর সমর্থক। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র শত্রুতা। কোনো দলে যোগ না দিলে গ্রামে টেকা যায় না।
দিগনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান তপন বলেন, প্রতি গ্রামে মাতুব্বরদের মধ্যে দলাদলি আছে। তিনি চেষ্টা করেন যাতে সংঘর্ষ না হয়। বুঝিয়ে সুজিয়ে তাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেন।
শৈলকুপা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান প্রবীণ রাজনীতিবিদ জাদিদুন্নবী কালু বলেন, দলাদলি, দাঙ্গামার কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা থামাতে হলে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মো. মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, শৈলকুপার গ্রাম্য মাতুব্বররা অশান্তিপ্রিয়। দাঙ্গা-হাঙ্গামা করা তাদের একটা কালচারে পরিণত হয়েছে। তিনি বিভিন্ন স্হানে বৈঠক করে তাদের অশান্তি সৃষ্টি না করতে বুঝিয়ে থাকেন। তার পরও তারা বুঝে না। মানুষ খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ। কেউ খুন হলে এক-দেড় শ মানুষকে আসামি করে। বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে। পুলিশকে পাহারা দিতে হয়।